হিন্দু পুরাণ বলছে, সমুদ্র মন্থনের সময় রাহু নামের এক অসুর লুকিয়ে কয়েক ফোটা অমৃত পান করে ফেলে। চন্দ্র এবং সূর্য রাহুকে চিনতে পেরে এ কথা বিষ্ণুকে বলে দেয়। অমৃত গিলে ফেলার আগেই বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্রের সাহায্যে রাহুর মাথা বিছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু অমৃত পানের ফলে মুন্ডটি অমরত্ব পেয়ে যায়, এতেই উৎপত্তি হয় রাহুর। বিষ্ণুকে বলে দেয়ায় সূর্য ও চন্দ্রের প্রতি রাহু বিক্ষুব্ধ হয়। এ কারণে বছরের একটা সময় রাহু এদের গ্রাস করে। কিন্তু ধর কাটা থাকায় গ্রহণের একটা নির্দিষ্ট সময় পর সূর্য ও চন্দ্র গ্রাস থেকে বের হয়ে যায়।
পালিশাস্ত্র বলছে, সূর্য ও চন্দ্রকে গ্রাস করার পর বুদ্ধের স্তোত্র পাঠ করে সূর্য ও চন্দ্র রাহুর কবল থেকে বেরিয়ে আসে। এরপর বুদ্ধ রাহুর মাথা কেটে সাত ভাগ করে দেয়। ইসলাম বলছে, সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ হচ্ছে আল্লাহর কুদরত।
আর জ্যোতির্বিজ্ঞান বলছে, ঘূর্ণায়মান অবস্থায় চাঁদ পৃথিবী এবং সূর্য সমান্তরালে আসলে চাঁদের উপর পৃথিবীর যে ছায়া পড়ে সেটি চন্দ্রগ্রহণ। আর ঘূর্ণনকালে সূর্যের গায়ে চাঁদের যে ছায়া পরে সেটাই সূর্যগ্রহণ।
অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রাচীন পুরাণ বিশ্বাসের সূত্র থেকেই সমাজে গ্রহণ নিয়ে নানা অপব্যাখ্যার প্রচলন রয়েছে। এই অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের কারণে খারাপ সময়কে মানুষ রাহুর দশা বলে প্রকাশ করে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে। বাংলাদেশের আকাশেও এখন এমন একটি গ্রহণকাল চলছে। এটি কি রাহুর গ্রাস নাকি কেবলই ছায়া সেটা জনগণের বোধগম্যতার বাইরে। কারণ বাংলাদেশ এমন কোনো আদর্শ রাষ্ট্র নয় যে, এখানে সবকিছু জনগণকে অবহিত করে করা হয়। বরং অনাদিকাল ধরে এই বঙ্গে জনগণ নামে রাষ্ট্রের প্রধান অনুষঙ্গটি কোনো গুরুত্বই পায়নি। আর জনগণও কীট পতঙ্গের মতো নির্জীব প্রাণী হিসেবে মৃত্যুর জন্যই বেঁচে থাকে।
নিজেকে এই কীট পতঙ্গের সাথে জড়িয়ে কথা বলার কারণ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার দুই দিনের ঝটিকা সফর। এ সফর নিয়ে সর্বত্র চলছে নানামুখী আলোচনা। এই আলোচনায় অজ্ঞ এবং বিজ্ঞের যুক্তির তরঙ্গ একাকার হয়েছে। দুই দেশের ক্ষেত্রেই বিষয়টি ছিলো অভিন্ন। অন্তত মিডিয়াগুলোর প্রতিবেদন দেখলে তাই মনে হয়। সফরপূর্ব এবং পরবর্তী সংবাদপত্রে ভারত সরকার এবং সেদেশের জনগণের চাওয়া খুবই স্পষ্ট। কিন্তু আমাদের বঙ্গের চাওয়া এবং পাওয়ার হদিস কেউ মেলাতে পেরেছেন এমনটি দেখিনি। রাষ্ট্র ও সরকার যা বলেছে তাতে নিজ উদ্যোগে কিছু বুঝে নেওয়ারও জো নেই। ফলে চারদিকের আলোচনায় কীট পতঙ্গের কিচির মিচির ছাড়া কিছুই মিলেনি।
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর, তিস্তার পানি ও বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার জন্য শ্রিংলা ঢাকা সফর করেছেন। গণমাধ্যম আরও বলেছে সাম্প্রতিক কালে দিল্লির সাথে ঢাকার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এই অবনতির হ্রাস টানাও সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য। সফর শেষে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ঢাকা সফরকে “অত্যন্ত সন্তোষজনক” বলে বর্ণনা করেছেন।
কোনো রাখঢাক না করেই ভারতীয় পত্রিকা এশিয়ান এইজ লিখেছে, “চীনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য বিদেশসচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেছেন। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে, বিশেষত বাংলাদেশে ভারতের প্রকল্পসমূহের তদারকির জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে একটি যৌথ পরামর্শক কমিশন গঠনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে দুই দেশ।”
নিউজ এইটিন লিখেছে, “ভারত তার বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, যার প্রক্রিয়া হিসেবে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক দূত শ্রিংলা দ্রুত সেখানে যান। নয়াদিল্লি প্রতিবেশী দেশগুলোতে চীনা বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তিস্তা নদীর সাথে সম্পর্কিত একটি প্রকল্পের জন্য চীনাদের সম্ভাব্য ঋণ তার সর্বশেষ ট্রিগার।
জি নিউজ বলেছে, “তিস্তার জল বন্টন নিয়ে নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে উত্তেজনা পুরনো। এরই মধ্যে, বেইজিং তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। এ পরিবেশে তড়িঘড়ি সফরের উদ্দেশ্য দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া।” ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
“তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ চীন থেকে ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পাবে, যা ভারতের সাথে পানি ভাগাভাগির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
দৈনিক আজকাল বলেছে, “বাংলাদেশে একটি বিমানবন্দর তৈরিতে ঢাকাকে সহযোগিতার ঘোষণা করেছিল ভারত। কিন্তু সম্প্রতি চীন তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে। এর পরে দিল্লি আর চুপ করে থাকতে পারেনি। লকডাউনের পর শ্রিংলা এই প্রথম বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনাও প্রথমবারের মতো কোনও বিদেশি অতিথির সাথে বৈঠক করবেন।” আনন্দবাজার ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাসের উদ্বৃতি দিয়ে বলেছে, “শ্রিংলার সফর দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে দিল্লির ‘বিশেষ বার্তা’।
ভারতীয় গণমাধ্যমের সংবাদে তিস্তা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে ভারত সরকারের উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। এছাড়া বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতির বিষয়টিও স্পষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের তরফে বলা হয়েছে করোনা-টিকার সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ভারতের সহযোগিতার বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। এছাড়া দুই দেশের যৌথ উৎসাহের জায়গাগুলিতে বোঝাপড়া বৃদ্ধি করার জন্য এই সফর। দুই দেশের অবস্থান ও বক্তব্য সম্পূর্ণ পৃথক। অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বিষয়ে একটা অস্পষ্টতা বা ছায়া অন্ধকার স্পষ্ট। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এই অস্পষ্টতা কি রাহু গ্রাস না-কি শুধুই ছায়া।
সফরের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণে পাওয়া যায় ভিন্ন বার্তা। সফর নিয়ে ভারতের আগ্রহ ও উদ্দীপনা যতবেশি, বাংলাদেশের সেই তুলনায় একেবারেই উল্টো। যেমন অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে শ্রিংলা আসলেন। বাংলাদেশ এটাকে পাত্তাই দেয়নি। অনেকের মতে নুন্যতম সৌজন্যবোধ দেখানোর প্রয়োজনীয়তাও এক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে। যেমন, শ্রিংলাকে বরণ করতে পররাষ্ট্র সচিব কিংবা মন্ত্রণালয়ের কেউ বিমানবন্দর যায়নি। শ্রিংলাকে বরণ করেতে বিমানবন্দরে কেবলমাত্র ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারাই উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেটে ডিসি অফিস প্রাঙ্গণের একটি কর্মসূচির অজুহাতে ঢাকার বাইরে চলে গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিলো বিকাল ৩ টায়। সেই বৈঠক হয়েছে ৬ ঘন্টা পর রাত ৯ টায়। বৈঠক সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা গেছে তাতে দেখা গেছে, শ্রিংলা বলেছেন আর প্রধানমন্ত্রী কেবল শুনেছেন এবং হ্যাঁ না এর মতো করে জবাব দিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তিস্তা নদীর পানি, সীমান্ত হত্যাকান্ড কমিয়ে আনা, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র এমনকি সাংবাদিক কনক সরোয়ারকে লে, জে, (অবঃ) হাসান সোহরাওয়ার্দীর দেয়া সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ নিয়েও কথা বলেছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা, সীমান্ত হত্যা বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু নিয়েই কিছু বলা হয় নি।
এদিকে চীন তিস্তা প্রকল্পের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার ঋণের ঘোষণা দিয়ে বসে থাকেনি। বরং সরকারকে চাপে রাখার জন্য খালেদা জিয়ার জন্মদিনে শুভেচ্ছাও পাঠিয়েছে। চীন বুঝাতে চেয়েছে তারা সরকার এবং বিরোধী দল সবার সাথেই একাত্ম হয়ে পথ চলতে চায়। চীনা দূতাবাস গত ১৪ আগস্ট বিকেলে ফুলের তোড়া পাঠায় বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে। গত ৩০ বছরেও চীন এমন শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায়নি। বিশেষ করে ২০০৪ সালের পর থেকে বিএনপির সাথে চীনের সম্পর্ক প্রায় দা-কুমড়ার। বিএনপি সে বছর তাইওয়ানকে বাংলাদেশে দূতাবাস খোলার অনুমতি দিলে এই বৈরিতা ও অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়। এই বৈরিতা ভুলে চীন আচমকা বিএনপি নেত্রীকে ফুলের শুভেচ্ছা পাঠিয়ে বাংলাদেশের প্রতি তার আগ্রহের গভীরতাকে স্পষ্ট করলো। অর্থাৎ বাংলাদেশকে নিয়ে দুই দেশের রশি টানাটানির চূড়ান্ত অবস্থা চলছে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে দুইদিকে দুই পা রেখে চলা সম্ভব হবে এমনটা কেউ মনে করছে না।
এখন দেখার বিষয় আমরা কি পুরাণের রাহুর কবলে পরে থাকবো, নাকি গ্রহণের পথ অতিক্রম করে একটি স্বচ্ছ ও শুভ্র ভোরের দিকে এগুতে পারবো।
নাছির উদ্দিনঃ
পাঠক, লেখক, বিশিষ্ট সাংবাদিক