মোঃ নাসির উদ্দিন,
সাবেক স্টাফ রিপোর্টার প্রথম আলো, আমাদের সময়ের স্পেশাল করেসপনডেন্ট:
পড়নে ছিলো সেনাবাহিনীর কমব্যাট টি সার্ট, কমব্যাট ট্রাউজার এবং ডেজার্ট বুট। পোশাকই যথেষ্ট ছিল গুলি না করার জন্য। কিন্তু কেন যেন বড্ড তাড়াহুড়ো ছিলো প্রাণে মেরে ফেলার। এজন্যই এই একটি হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুরো পুলিশ বাহিনীই এখন কাঠগড়ায়। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এই হত্যাকাণ্ড জরুরী মনে করেছিল টেকনাফ পুলিশ? সিনহা রাশেদকে কি পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে? না-কি পুলিশের অপকর্মের নিরব বলি হয়েছে রাশেদ? প্রতিটি হত্যাকান্ডেরই কোনো না কোনো মুটিভ থাকে। নিশ্চয়ই রাশেদ খুনেরও মুটিভ ছিলো। কিন্তু কি সেই মুটিভ বা কারণ, সেই তথ্য এখনো অজানা।
তবে এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্যসূত্রগুলো বলছে, দুটি কারণ হতে পারে রাশেদ হত্যার। এক. ওসি প্রদীপ কুমার দাস রাশেদকে নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কারণ গত একমাস ধরে রাশেদ কক্সবাজারে ঘুরেঘুরে হাইকিংয়ের যে ডকুমেন্টারি (তার Just Go চ্যানেলের জন্য) তৈরী করছিলেন, সেটা কি সত্যিই ডকুমেন্টারি ছিলো, না-কি প্রদীপের এবং পুলিশের অপরাধ জগতের জাল চিহ্নিত করা হচ্ছিলো? সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন ওসি প্রদীপের ধারণা হয়ে থাকতে পারে ডকুমেন্টারির নামে মেজর রাশেদ, প্রদীপকে ফাঁসানোর জাল তৈরী করছে। এবং ইতোমধ্যে রাশেদের কাছে অনেক তথ্যাদি পৌঁছে গেছে। এজন্য তাকে মেরে ফেলার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল প্রদীপ। দুই. দীর্ঘদিন ধরে টেকনাফ এলাকায় হাকিম ডাকাত মানুষকে নিপীড়ন করেই যাচ্ছে। পুলিশ কোনোভাবেই তাকে ধরতে পারছে না। ওসির সন্দেহ হয়ে থাকতে পারে মেজর রাশেদের সাথে হাকিম ডাকাতের কোনো যোগসূত্র ঘটে থাকতে পারে। কারণ টেকনাফের বনে জঙ্গলে গত একমাস নিয়মিত ট্র্যাকিং এবং স্যুটিং করতো রাশেদ।
অবশ্য কোনো সংস্থা বা বাহিনী থেকে ঘটনার কারণ নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। পুলিশ বলছে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু বিপরীত পক্ষ এমন সরলীকরণ মেনে নেয়নি। ওরা বলছে, সামরিক পোশাক দেখা এবং পরিচয় দেয়া স্বত্বেও, কোনোপ্রকার কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ সামরিক বাহিনীর প্রতি চরম অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা এবং ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। শুধু তাই নয়, মৃত্যুপথযাত্রী রাশেদের মুখমন্ডলে ওসি প্রদীপ এবং এসআই লিয়াকতের এলোপাতাড়ি লাথি মারাও ছিলো ন্যাক্কারজনক। ঘটনাস্থলে পরিচয় দেয়ার পরও একজন এএসইউ সদস্যের সামরিক বাহিনীর পরিচয়পত্র ও ফোন ছিনিয়ে নেয়াও বাহিনীর প্রতি অবমাননাকর। মেজর রাশেদকে হাসপাতালে নেয়ার আগে যেন মৃত্যু নিশ্চিত হয় সেজন্য অহেতুক বিলম্ব করার ঘটনাও ছিলো পৈশাচিক। এছাড়া কক্সবাজার পুলিশের মধ্যে ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতা ও উৎসব অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এসআই লিয়াকত একজন জঘন্য মাদক গ্রহনকারী। যদিও রাশেদ ও সিফাতদের ব্যপারেও মাদক গ্রহণের অভিযোগ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ঘটনার দিন রাতে শুটিং শেষে পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় ২/৩ জন স্থানীয় লোক ডাকাত সন্দেহে পুলিশে খবর দিয়েছিল।
এদিকে, রাশেদ হত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবীর সাথে এলোমেলো কথা ও কাঁদা ছোড়াছুড়ির মাত্রাও চলছে দেশজুড়ে। পত্র পত্রিকা ইলেকট্রনিক মিডিয়া ফেসবুক ইউটিউব টুইটার সর্বত্রই এ নিয়ে হুড়োহুড়ি। দেশে রাজনীতির চর্চা না থাকলে মানুষ অপ্রাসঙ্গিক ইস্যু নিয়েও হৈচৈ করবে, এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। সে তুলনায় রাশেদের বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর এবং হিংসাত্মক ঘটনা। সরকারও বসে নেই, যেচে পড়েই কথা বলছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, একটি অশুভ চক্র নানা ইস্যুতে গুজব রটনা ও অপপ্রচারে লিপ্ত। সাবেক সেনাসদস্য মেজর রাশেদের মর্মান্তিক ঘটনাকে ঘিরে কেউ কেউ দুই বাহিনীর মধ্যে উসকানি দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। জনগণ এসব বিষয়ে সচেতন রয়েছে। এ ধরনের ঘটনাকে ইস্যু করে সরকার হটানোর মতো দিবা স্বপ্ন দেখছে কেউ কেউ। শেখ হাসিনার সরকারের শিকড় এ দেশের মাটির অনেক গভীরে। গুজব রটিয়ে, অপপ্রচার চালিয়ে কোনো লাভ হবে না। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন হবে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার বন্ধে দেশ-বিদেশে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার অনুরোধ জানান তিনি”। তিনি সচেতনভাবেই এটিকে ‘মর্মান্তিক ঘটনা’ বলেছেন, হত্যাকাণ্ড বলেননি।
তাঁর বক্তব্যে ধারণা হতে পারে, যেচে পড়ে কথা বলে এই মামলার গতি প্রকৃতি বাতলে দিচ্ছেন তিনি। আর এটি করার অর্থ হবে ওই পুলিশের অপরাধকে মাটিচাপা দেয়ার চেষ্টা করা। সরকার গোপনেও এমন কোনো উদ্যোগ নিলে সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই তা মেনে নেবে না। কারণ জনগণের জানমাল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই খুনি চেহারার ওপর মানুষ বীতশ্রদ্ধ। দেশজুড়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের অন্ত নেই। ইদানিংকালে পুলিশের কাছ থেকে মানবিক আচরণ পাওয়ার কোনো নজির ভূ-বাংলায় ঘটেছে এমনটি শোনা যায়না। পুলিশের এই একচেটিয়া হায়েনা রূপি আচরণে, মানুষের কাছে পুলিশ এখন নীলকর যুগের জমিদারির সেই হানাদার দস্যুদের চেহারার প্রতিচ্ছবি। এখনকার মানুষ সেই দস্যুদের দেখেনি। কিন্তু বর্তমান দস্যুপ্রবৃত্তি চোখে দেখছে। এই পুলিশ যেন রাষ্ট্রের কর্মচারী নয়, নিজেদেরকে ভাবছে রাষ্ট্রের মনিব। অবশ্য মন্ত্রী, এমপি, আমলা থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের কর্মচারীদের মনোভাবই অভিন্ন। রাষ্ট্রের কর্মচারীদের ভাবনার এই ঘাটতি, মূল্যবোধহীনতার কারণে। আর এই ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রের। কারণ রাষ্ট্রের অন্যতম অনুষঙ্গ বা স্তম্ভ হচ্ছে তার জনগোষ্ঠী, সেই জনগোষ্ঠীকে এখন রাষ্ট্রের বা সরকারের প্রয়োজন হয় না। এজন্য পুলিশের ঘটনায় মানুষ রাষ্ট্রকে বা সরকারকে পাশে পায় না। রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষে সাফাই গায়। পুলিশও সর্বত্রই সরকারের সহায় হয়ে কাজ করে। ফলে মানুষ ভাবছে, দেশের পুলিশের কাছে তারা পুরোপুরি জিম্মি। এই অসহায়ত্বের কারণে মানুষ এই হত্যাকাণ্ডটিকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীকে তার ক্ষোভের সঙ্গী ভাবছে। কারণ এই জিম্মিদশা থেকে পরিত্রাণ চায় সাধারণ মানুষ। রাশেদ হত্যার পর মানুষের মধ্যে যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া, এবং এই প্রতিক্রিয়ার যে বার্তা, সেটি যদি সরকার এবং পুলিশ বাহিনী বুঝতে পারে তাহলেই জাতির জন্য মঙ্গল। অন্যথায় অমঙ্গল অবশ্যম্ভাবী।
প্রসঙ্গতঃ টেকনাফে শুধু রাশেদ